ঢাকা, ০৯ আগস্ট শনিবার, ২০২৫ || ২৪ শ্রাবণ ১৪৩২
good-food

এক সিপাহসালার এলিজি 

লাইফ টিভি 24

প্রকাশিত: ২২:২৭ ৮ আগস্ট ২০২৫  

১. সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হারুন অর রশিদ চলে গেলেন চিরশান্তির দেশে। তিনি আপাদমস্তক পেশাদার সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় শ্রম, মেধাদীপ্তি, সৌকর্যে সবকিছু মিলিয়ে এক চৌকস সিপাহসালার চলে যাবার মুহূর্ত আরও গৌরবোজ্জ্বল হতে পারতো। চট্রগ্রাম ক্লাবে একাকী মৃত্যু একজন সেনাপতিকে মানায় না। 

 

২. তৃতীয় বিশ্ব'র প্রায় অধিকাংশ দেশে সেনাবাহিনীকে রাজনীতির ঘেরাটোপে আটকে যেতে হয়। সেনাপ্রধান না চাইলেও সিস্টেম রাজনীতির চোরাগলিতে সেনাবাহিনীকে  আটকাতে চেষ্টা করে। তাই, তাদের বলতে হয়, "আমি তো প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার উপর পড়েছে"। সারা জীবন সাপে-নেউলে লড়াইয়রত দুই প্রধান রাজনৈতিক দল এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাকে প্রায়ই স্যান্ডউইচ হতে হয়েছে।

 

প্রতিহিংসায় তাকে বারংবার "ডাম্পিং" এ পয়েন্টমেন্টের কন্টক মুকুট পরিয়ে দেয়া হয়েছে। বিধাতা বারবার তাঁর সাথে বৈমাত্রেয় ভ্রাতার মত আচরণ করেছে। খুব নিকটজনের জটিল রোগ তাঁর "একিলিসের গোড়ালি" হয়ে প্রায় আমৃত্যু কষ্ট দিয়েছে। অসুস্থজনের পাশে সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে সুবহে সাদিকে সেনানীদের সাথে দৌঁড়েছেন। একবুক কষ্ট চেপে দিনের পর দিন হাসিমুখে সহকর্মীদের সাথে কথা বলেছেন। 

 

৩. তিনি তখন সদ্য কমিশন পাওয়া সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। দেশ মাতৃকা তখন লড়ছে। অসম শক্তির বিরুদ্ধে। কৈশোরের গন্ধ শরীরে মুছে না যেতেই অস্ত্র তুলে নিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্ব গাঁথা আজও এক কিংবদন্তি। 

 

৫. আমি তখন ঘাটাইলে, চাকরির বয়স সাকুল্যে তিন বছর। আর তিনি স্বয়ং জি ও সি মহোদয়। বাংলার ইতিহাস নিয়ে তিনি কিছু একটা মঞ্চায়ন করতে চান। আমার অধিনায়ক আমাকে জিওসির সামনে ঠেলে দিলেন। আমি ময়মনসিংহ গীতিকার আদলে আমার লেখা "ইতিহাস কথা কও" স্ক্রিপ্ট তাঁকে বোঝালাম।(ক্যাপ্টেন সাহেব বোঝাচ্ছেন জেনারেলকে?) দৃশ্যপট নবাব সিরাজ, মিরজাফরের কূটকৌশল, ইংরেজ বেনিয়ার অনুপ্রবেশ, মংগল পান্ডের সিপাহী বিদ্রোহ, লর্ড মাউন্টব্যাটেনের আবির্ভাব ইত্যাদি ইত্যাদি।

 

(কিছু ছবি সংযুক্ত করা হল।) ডিভিশনের হাজার সৈনিক, শতাধিক অফিসার, তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মুস্তাফিজের সামনে পরিবেশিত হল শুধু রচনাই নয় নির্দেশনা, প্রপস এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা একাংকিকা "ইতিহাস কথা কও"। অনুষ্ঠান শেষে যেভাবে একজন জিওসি খোদ সেনাপ্রধানের সামনে তরুণ অফিসারকে পরিচয় করিয়ে এক টেবিলে রাতের খাবার খেলেন সেই স্মৃতি আজও আমার অনুপ্রেরণা। 

 

৬. তিনি তখন চীফ অব জেনারেল স্টাফ। সিজি এস। আমার সস্ত্রীক ডাক পরলো তাঁর বাসভবনে। আমি ঘেমে নেয়ে একাকার। মাতৃস্নেহে ম্যাডাম লায়লা নাজনীন হারুন আমার পাতে খাবার তুলে দিয়ে সেনাবাহিনীতে মুক্তমনস্ক, আমাদের চিরায়ত দেশীয় সংস্কৃতির ঘেরাটোপে থেকে সৃষ্টিশীল নতুন কি করা যায় তার অলিখিত খসড়া তৈরি করা হল। আমি তখন আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল ইন্সটিটিউটের ট্রেইনি। তিনি ততদিনে খোদ সেনাপ্রধানের পদে অভিষিক্ত হয়েছেন। বৃক্ষ তাঁর ভারে অবনত। আমাকে ডেমিঅফিসিয়াল পত্রে সেনাপ্রধান সন্মানিত করলেন।

 

কয়েক বছর আগে। সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবস। তাঁর বজ্রভেদী দৃষ্টিতে আমি বন্দী হলাম। হাতের ইশারায় কাছে ডেকে বললেন, "লেখালেখি মৌলিক বিষয়। সবাইকে দিয়ে হয় না। তুমি পেরেছো। ধারাবাহিকতা রাখলে তুমি পারবে। "স্মিত হাস্যে আমার স্ত্রীকে বললেন, "খোশরোজ, গড গিফটেড প্রতিভা, দেখে রাখবেন সে যেন লেখালেখি চালিয়ে যায়"। অন্তত আমি জানি (আমি কত বড় ঘোড়ার ডিমের প্রতিভা!) কিন্তু, প্রায় দুই দশক পরে ছোট একাংকিকার স্মরণ রাখা তাঁর অতীন্দ্রিয় স্মৃতি এবং শিল্প -সাহিত্যেসহ বহুমাত্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি প্রগাঢ় উৎসাহকেই প্রকাশ করে। 

 

৭. কোন মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু তার মাশুল তাঁকে চড়া দামে কিনতে হয়েছিল। তাঁর ইচ্ছায় চট্রগ্রামে তাঁর পিতার কবরে তাঁকে দাফন করা হবে। চিরবিদায় লগ্নে ভুল পরিমাপের ফ্যাদোমিটারে মেপে কি আমাদের আরেকবার জাজমেন্টাল হতেই হবে?

 

লেখক: মেজর ডা. খোশরোজ সামাদ 

ক্লাসিফাইড স্পেশালিস্ট বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস।